দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করার ধারণাটি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি প্রাথমিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০০০ সালে প্রবর্তিত হয়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃক চালু হওয়া এই শ্রেণিবিন্যাস প্রাথমিকভাবে ‘এ’ ও ‘বি’ শ্রেণি দিয়ে শুরু হয়ে পরবর্তীতে ‘জেড’, ‘জি’ এবং সবশেষে ‘এন’ শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বর্তমানে বাজারে ৩৯৭টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড এই পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত, যেখানে সরকারি ও কর্পোরেট বন্ডসহ অন্যান্য ঋণ উপকরণ এই শ্রেণীকরণের বাইরে রাখা হয়েছে।
শ্রেণি মান প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট:
শেয়ারবাজারে শ্রেণিবিন্যাস চালুর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুটি:
১. বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা: ভালো ও দুর্বল কোম্পানি চিহ্নিত করে বিনিয়োগকারীদের সঠিক পথে চালিত করা। 2. ঋণ প্রদানে মানদণ্ড: ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর শেয়ারের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানি বাছাইয়ের ভিত্তি তৈরি করা।
ঢাকা চেম্বারের এক আলোচনা সভায় উত্থাপিত সুপারিশের ভিত্তিতে এই শ্রেণীকরণের ধারণাটি বাস্তবে রূপ নেয়, যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও ইতিবাচক সাড়া দেয়। ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম অক্ষর ‘এ’ দিয়ে ভালো কোম্পানি এবং ক্রমান্বয়ে ‘বি’, নতুন কোম্পানির জন্য ‘এন’ ও গ্রিনফিল্ড প্রকল্পের জন্য ‘জি’ শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। তুলনামূলকভাবে দুর্বল কোম্পানিগুলোকে চিহ্নিত করতে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ‘জেড’ শ্রেণি নামকরণ করেন।
বিভিন্ন শ্রেণির মানদণ্ড:
- * ‘এ’ শ্রেণি: নিয়মিত এজিএম এবং কমপক্ষে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদানকারী কোম্পানি।
- * ‘বি’ শ্রেণি: নিয়মিত এজিএম কিন্তু ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ প্রদানকারী কোম্পানি।
- * ‘এন’ শ্রেণি: নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি।
- * ‘জি’ শ্রেণি: গ্রিনফিল্ড কোম্পানি (বর্তমানে এই শ্রেণিতে কোনো কোম্পানি নেই)।
- * ‘জেড’ শ্রেণি: অনিয়মিত এজিএম, লভ্যাংশ প্রদানে ব্যর্থ এবং টানা ছয় মাসের বেশি উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানি।
ঋণ সুবিধা ও অন্যান্য নিয়ম:
শেয়ারবাজারের নিয়ম অনুযায়ী, ‘এ’, ‘বি’, ‘এন’ ও ‘জি’ শ্রেণির শেয়ারের বিপরীতে ঋণ সুবিধা প্রদান করা হয়। তবে এর জন্য পিই রেশিও ৪০-এর নিচে থাকা সহ আরও কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। নতুন তালিকাভুক্ত ও শ্রেণি পরিবর্তনকারী কোম্পানির শেয়ারে প্রথম ৩০ কার্যদিবস ঋণ সুবিধা বন্ধ থাকে।
শ্রেণীকরণের বিবর্তন ও বিতর্ক:
কাগুজে শেয়ারের যুগে ডিএসইর নিজস্ব ক্লিয়ারিং হাউসের মাধ্যমে এই শ্রেণিভুক্ত কোম্পানিগুলোর লেনদেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নিষ্পত্তি হতো, যেখানে ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ারের নিষ্পত্তিতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগত। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যানের মেয়াদে লেনদেন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘জেড’ শ্রেণির শেয়ারের নিষ্পত্তি সময় কমানো হলেও, শ্রেণীকরণের মানদণ্ডে পরিবর্তন আনায় অনেক দুর্বল কোম্পানিও ভালো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পায়। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রায়শই বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন।
বর্তমানে ডিএসইতে ‘এ’ শ্রেণিতে ২২৯টি, ‘বি’ শ্রেণিতে ৮২টি, ‘এন’ শ্রেণিতে ৪টি এবং ‘জেড’ শ্রেণিতে ৮২টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। গ্রিনফিল্ড শ্রেণির একমাত্র কোম্পানি লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট বর্তমানে একীভূত হয়ে লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট নামে লেনদেন করছে।
শেয়ারবাজারে কোম্পানির শ্রেণীকরণ প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহায়ক ধারণা হিসেবে চালু হলেও, সময়ের সাথে সাথে এর মানদণ্ডে পরিবর্তন এবং দুর্বল কোম্পানিগুলোর উচ্চতর শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক বিনিয়োগকারী এখন এই শ্রেণিবিন্যাসের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে দ্বিধা বোধ করছেন। বাজার সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় শ্রেণীকরণের মানদণ্ড আরও কঠোর করা এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায়, শেয়ারবাজারের এই শ্রেণিবিন্যাস সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রত্যাশিত সুবিধা বয়ে আনতে ব্যর্থ হতে পারে।
0 মন্তব্যসমূহ