Header Ads Widget


যেখানে বিশ্বাস, সেখানেই অসম্ভবকে সম্ভব করার বিস্ময়কর মন্ত্র!

মানব জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে অসংখ্য সম্ভাবনা, যা আমরা প্রায়শই নিজেদের অজান্তেই দাবিয়ে রাখি। কখনও সমাজের বেঁধে দেওয়া সংজ্ঞা, কখনওবা নিজেদের তৈরি করা অদৃশ্য দেয়াল আমাদের অদম্য স্বপ্নগুলোকে ফিকে করে দেয়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু মানুষ অমর হয়ে আছেন, যারা প্রমাণ করেছেন, অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাসে রূপান্তরিত করার শক্তিই হলো সাফল্যের আসল মন্ত্র। আজ আমরা এমন দুটি অসাধারণ গল্পে ডুব দেবো, যেখানে ভালোবাসা আর সরল বিশ্বাসের জোরে অসম্ভবও হার মেনেছিল, যেখানে প্রতিটা 'না' পরিণত হয়েছিল এক নতুন 'হ্যাঁ'-তে। এই গল্পগুলো শুধু দুটি মানুষের সাফল্যের উপাখ্যান নয়, বরং আমাদের প্রত্যেকের ভেতরের সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার এক অবিস্মরণীয় আহ্বান। চলুন, দেখে নিই কীভাবে বিশ্বাস আর ভালোবাসার জাদুতে ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো অমর কীর্তি।
faith

১। টমাস আলভা এডিসন, একটা নাম যা আজও আমাদের আলোর পথের দিশা দেখায়। কিন্তু তার ছোটবেলার গল্পটা কেমন ছিল জানেন? তিনি নাকি পড়ালেখায় মোটেও ভালো ছিলেন না, স্কুলে গেলেই ক্লাসের পেছনে পড়ে থাকতেন। একবার পরীক্ষার ফলাফল যা এলো, তা তো আরও খারাপ!

সেই রেজাল্টের দিনে হেডমাস্টার একটা ভাঁজ করা চিঠি এডিসনের হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, "চিঠিটা এখানে খুলবে না, সোজা বাড়ি গিয়ে মায়ের হাতে দেবে।" ছোট্ট এডিসন সেই চিঠি নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ি ফিরলেন। মায়ের হাতে চিঠিটা দিয়ে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "মা, কী লেখা আছে চিঠিতে?"

মা মৃদু হাসলেন, সেই হাসিটা যেন পৃথিবীর সব মায়া আর ভালোবাসা দিয়ে মাখা। তিনি জোরে জোরে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন, "আপনার ছেলে ভীষণ মেধাবী! এই স্কুল তার জন্য অনেক ছোট। তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট ভালো শিক্ষক আমাদের নেই। দয়া করে, আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।" মায়ের মুখে এই কথাগুলো শুনে ছোট্ট এডিসনের চোখগুলো আনন্দে চকচক করে উঠল।

সেই দিন থেকে শুরু হলো মায়ের কাছে এডিসনের পড়ালেখা। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে গেল। মায়ের হাতে গড়া সেই ছেলেটা একদিন হয়ে উঠলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের একজন। যে ইলেকট্রিক বাল্ব আজ আমাদের ঘর আলোকিত করে রেখেছে, তার আবিষ্কারক তিনিই। কিন্তু এত বড় সাফল্যের সাক্ষী হতে পারলেন না তার প্রিয় মা। তার আগেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

অনেক বছর পর, এডিসন একদিন পুরোনো কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন। হঠাৎ একটা ভাঁজ করা কাগজের দিকে তার চোখ আটকে গেল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা তুলে নিলেন। খুলে দেখলেন, আরে! এটা তো সেই ছোটবেলার স্কুলের চিঠি!

চিঠিটার ভেতরের লেখাগুলো তার চোখকে ভিজিয়ে দিল। সেখানে লেখা ছিল, "আপনার সন্তান স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন এবং মেধাহীন। সে এই স্কুলের উপযুক্ত নয়। আমরা তাকে আর কোনোভাবেই স্কুলে রাখতে পারব না।"

পড়তে পড়তে এডিসনের চোখের কোণ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। তার মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়তে লাগল। কতটা ভালোবাসা আর আত্মত্যাগ ছিল তার মায়ের! তখনই তিনি তার ডায়েরিতে লিখলেন: "টমাস আলভা এডিসন ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ এবং জড়বুদ্ধিসম্পন্ন শিশু, কিন্তু তার মা তাকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।"
মায়ের বিশ্বাস আর ভালোবাসা কীভাবে একটা জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিতে পারে, এই গল্পটা তার এক জীবন্ত প্রমাণ।


২। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। গণিত ক্লাস চলছে। ক্লাসে প্রফেসর তাঁর ছাত্রদের সামনে জটিল গাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন। ক্লাসরুমে ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে শুনছে, কিন্তু একজন ছাত্র, জর্জ ডান্টজিগ, ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি হয়তো আগের রাতে পড়াশোনা করেছিলেন বা অন্য কোনো কারণে ক্লান্ত ছিলেন। যাই হোক, তিনি ক্লাসের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটান। ক্লাস শেষ হওয়ার পর ছাত্রদের চেঁচামেচি আর হট্টগোলের শব্দে তাঁর ঘুম ভাঙে। তিনি তাকিয়ে দেখেন, হোয়াইটবোর্ডে দুটি গাণিতিক সমস্যা লেখা রয়েছে। তিনি ধরে নেন, এই সমস্যাগুলো পরের ক্লাসের জন্য হোমওয়ার্ক হিসেবে দেওয়া হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে তিনি সমস্যা দুটি খাতায় টুকে নেন এবং ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান।


বাড়ি ফিরে জর্জ সমস্যা দুটির সমাধান করতে বসেন। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টার পর তিনি বুঝতে পারেন, এই সমস্যাগুলো অত্যন্ত জটিল এবং সমাধান করা সহজ নয়। সাধারণ হোমওয়ার্কের মতো এগুলো সরল গাণিতিক সমীকরণ নয়, বরং এগুলোর জটিলতা তাঁকে বিস্মিত করে। তবুও তিনি হাল ছাড়েন না। তাঁর মধ্যে একটি জেদ কাজ করে। তিনি ভাবেন, যেহেতু এটি হোমওয়ার্ক, তাই এটি অবশ্যই সমাধানযোগ্য। এই বিশ্বাস তাঁকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করে।


জর্জ লাইব্রেরিতে ছুটে যান। তিনি একের পর এক রেফারেন্স বই ঘাঁটতে থাকেন। গণিতের বিভিন্ন শাখা, তত্ত্ব, এবং সমীকরণ নিয়ে পড়াশোনা করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন কাটিয়ে দেন লাইব্রেরির টেবিলে। তাঁর মনের মধ্যে একটিই লক্ষ্য—এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। অবশেষে, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনি একটি সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হন। দ্বিতীয় সমস্যাটি তাঁর কাছে তখনও অমীমাংসিত থেকে যায়, কিন্তু প্রথম সমস্যার সমাধান তাঁকে আনন্দে ভরিয়ে দেয়।


পরবর্তী ক্লাসে জর্জ তাঁর সমাধান নিয়ে প্রফেসরের কাছে যান। তিনি ভেবেছিলেন, এটি হোমওয়ার্ক জমা দেওয়ার সময়। কিন্তু প্রফেসরের কাছে গিয়ে তিনি যে কথা শুনলেন, তা তাঁকে হতবাক করে দেয়। প্রফেসর তাঁকে জানান, হোয়াইটবোর্ডে লেখা সমস্যা দুটি কোনো হোমওয়ার্ক ছিল না। বরং, এগুলো ছিল গণিতের জগতে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত দুটি জটিল সমস্যা। প্রফেসর সেদিন ক্লাসে আলোচনা করছিলেন বিজ্ঞানের এমন কিছু সমস্যা নিয়ে, যেগুলো এখনো কেউ সমাধান করতে পারেনি। এই সমস্যাগুলো ছিল উদাহরণ হিসেবে, যাতে ছাত্ররা বুঝতে পারে গণিত এবং বিজ্ঞানের জগতে কতটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।


জর্জের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। তিনি ভেবেছিলেন, এটি একটি সাধারণ হোমওয়ার্ক, কিন্তু বাস্তবে তিনি একটি অমীমাংসিত গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন! তিনি প্রফেসরকে বললেন, “কিন্তু আমি তো একটি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি!” প্রফেসর প্রথমে হয়তো বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু জর্জ যখন তাঁর সমাধান দেখালেন, তখন প্রফেসর বিস্মিত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই তরুণ ছাত্রটি এমন একটি কাজ করে ফেলেছেন, যা গণিতের জগতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে উঠতে পারে।


জর্জের এই সমাধানটি শুধুমাত্র একটি ক্লাসরুমের গল্পে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাঁর সমাধানটি পরবর্তীতে প্যাটেন্ট করা হয় এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ডকুমেন্টেড করা হয়। তাঁর লেখা পেপারগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শিত হয়, যা আজও গণিতের ছাত্রদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। জর্জ ডান্টজিগের এই কৃতিত্ব গণিতের জগতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তিনি সমাধান করেছিলেন এমন একটি সমস্যা, যা গণিতবিদদের মধ্যে বহুল প্রয়োজনীয় “ম্যাথম্যাটিক্স স্ট্যাক এক্সচেঞ্জার” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।


জর্জের এই সাফল্যের পেছনে একটি মূল কারণ ছিল—তিনি ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এই ঘুমের কারণে তিনি প্রফেসরের সেই কথা শুনতে পাননি যে, “এই সমস্যাগুলো এখনো কেউ সমাধান করতে পারেনি।” তিনি জানতেন না যে এগুলো অমীমাংসিত সমস্যা। তাঁর মনে ছিল একটি সরল বিশ্বাস—এটি একটি হোমওয়ার্ক, এবং এটি সমাধান করা সম্ভব। এই বিশ্বাস তাঁকে ভয়, উদ্বেগ, বা নেতিবাচক চিন্তা থেকে মুক্ত রেখেছিল। তিনি নিজের যোগ্যতার উপর ভরসা রেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিলেন।

আমরা যদি নিজেদের উপর ভরসা রাখি এবং অটল থাকি, তাহলে অসম্ভব বলে কিছুই নেই। এই দুটি গল্প কি আপনার হৃদয়ে বিশ্বাস আর সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দেয়নি? টমাস এডিসনের মায়ের অটুট আস্থা আর জর্জ ডান্টজিগের সরল বিশ্বাস প্রমাণ করে যে, আমাদের ভেতরের শক্তি অজান্তেই সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। যদি একটি মা তার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারেন মিথ্যাকে অবলম্বন করে, আর একজন ছাত্র শুধুমাত্র 'অজানা' থাকার কারণে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারেন, তাহলে আপনার ভেতরের অদম্য সম্ভাবনা কেন মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে?

আর কতদিন আপনি 'পারব না' বা 'অসম্ভব' শব্দগুলোকে অজুহাত বানাবেন? আপনার স্বপ্নগুলো কি স্রেফ কল্পনা হয়েই শেষ হবে?

এখনই সময় জেগে ওঠার! আপনার ভেতরের সেই এডিসনকে জাগিয়ে তুলুন, যিনি মায়ের বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করেছিলেন। সেই ডান্টজিগ হয়ে উঠুন, যিনি প্রচলিত ধারণাকে পাশ কাটিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছিলেন।

আপনার জীবনের গল্পে আপনিই নায়ক। তাই আর দেরি না করে, আজই নিজের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন। আপনার ভেতরের সুপ্ত ক্ষমতাকে উন্মোচন করুন। মনে রাখবেন, আপনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাগুলো তখনই প্রকাশ পায়, যখন আপনি নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে যাত্র শুরু করবেন।

তাহলে, আপনি কি প্রস্তুত আপনার জীবনের 'অসম্ভব'গুলোকে 'সম্ভব' করতে? এখনই শুরু করুন আপনার যাত্রা!

লেখক: এম এস হাবিবুর রহমান, সম্পাদক ও প্রকাশক, নিউজ সমাহার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ