Header Ads Widget


নিরানব্বইয়ের বাধা - এম এস হাবিবুর রহমান

শিশিরকে দেখলে মনে হতো, সে যেন স্বপ্ন বুনতে আর ভাঙতেই জন্মেছে। ওর চোখের গভীরে এক অদম্য জেদ ছিল, যা ওকে বারবার নতুন কিছু শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করত। কিন্তু সেই জেদই যেন ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল। সে একজন উদ্যোক্তা হতে চায়। অনেক বছর ধরে বিভিন্ন ছোটখাটো ব্যবসার চেষ্টা করেছে—নার্সারি দিয়ে চারা বিক্রি, পুরনো বইয়ের দোকান, এমনকি স্থানীয়ভাবে তৈরি পোশাকের ব্যবসাও। প্রতিবারই সে খুব নিষ্ঠার সাথে কাজ শুরু করে, নিজের সমস্ত শক্তি আর সময় ঢেলে দেয়। কিন্তু বারবারই এক অদৃশ্য প্রাচীরের সামনে এসে থমকে যায়। তার মনে হয়, সে যেন সাফল্যের দোরগোড়ায় এসেও ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।

এম এস হাবিবুর রহমান

সবশেষ শিশির শুরু করল অনলাইন শপ। তার ধারণা, ঘরে বসেই অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে সে সফল হতে পারবে। নানা ধরনের কসমেটিকস আর ছোট ছোট গিফটের জিনিস সে সংগ্রহ করল। ভালো ছবি তুলে আপলোড করল, পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ লিখল, আর রাত-দিন এক করে প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রথম কয়েক মাস ভালোই চলল। কিছু অর্ডার আসতে শুরু করল, অল্প অল্প লাভও হচ্ছিল। শিশিরের চোখে তখন নতুন স্বপ্ন। এই বুঝি তার পরিশ্রম সফল হতে চলেছে!

কিন্তু বিপত্তি বাধল ঠিক তখনই। হঠাৎ করেই অর্ডার কমে যেতে লাগল। বিজ্ঞাপন খরচ বাড়ছে, কিন্তু বিক্রি সেই তুলনায় বাড়ছে না। স্টক জমে যাচ্ছে, নতুন পণ্য কেনার টাকা নেই। শিশিরের মনে হলো, সে যেন আবারও সেই চিরচেনা "নিরানব্বইয়ের বাধা"-র সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে জানে, শতভাগ প্রচেষ্টার নিরানব্বই ভাগই সে সম্পন্ন করেছে, কিন্তু বাকি এক ভাগের জন্যেই যেন সবকিছু থমকে যাচ্ছে। তার ভেতরের উদ্যম ক্রমশ নিভে আসছিল। একসময় সে পণ্যের মান, অনলাইন মার্কেটিং কৌশল, গ্রাহক সেবা, সবকিছু নিয়ে চরম হতাশায় ভুগতে শুরু করল। মনে হলো, এই বুঝি তার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন শেষ।

এক বিকেলে হতাশার এক গভীর খাদে ডুবে শিশির তার বন্ধু হাবিবের কাছে গেল। হাবিব, নামের মতোই তার স্বভাব—শান্ত, বিনয়ী ,বিচক্ষণ এবং পরোপকারী স্বভাবের মানুষ। সে কারো ক্ষতি করা তো দূরে থাক, সে কল্পনাও করতে পারে না। বরং সে সব সময় মানুষের ভালো চায়, বিপদে পাশে দাঁড়ায়। শিশিরের হতাশ চেহারা দেখে হাবিব বুঝতে পারল, তার বন্ধু আবারও সেই চেনা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। 

শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার সব হতাশার কথা খুলে বলতে লাগলো হাবিবের কাছে। বুঝতে পারছি না হাবিব, কেন এমন হচ্ছে! প্রতিবারই মনে হয় এই বুঝি সফল হব, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে সব ভেস্তে যায়। আমি বুঝতে পারি না, আমার সমস্যা কোথায়।

হাবিব মনোযোগ দিয়ে সব শুনল। এরপর শিশিরের কাঁধে হাত রেখে শান্ত গলায় বলল, আবার সেই পুরনো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস? নিরানব্বইয়ের বাধা? শিশির, তোর পরিশ্রম নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তুই সত্যিই খুব পরিশ্রমী। কিন্তু অনলাইন ব্যবসা শুধু ভালো পণ্য আর সুন্দর ছবি দিয়ে হয় না। এখানে আরও কিছু বিষয় আছে যা হয়তো তোর চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে।

হাবিব মৃদু হেসে বলল, তোর সমস্যাটা আসলে তোর নিজের হাতেই। তুই নিরানব্বই ভাগ কাজ করে বাকি এক ভাগেই হাল ছেড়ে দিস। এই এক ভাগই হচ্ছে সাফল্যের চাবিকাঠি।

শিশির অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

হাবিব বোঝাতে শুরু করল, দেখ শিশির, অনলাইনে ব্যবসা মানে শুধু পণ্য আপলোড আর প্রচার নয়। এটা একটা বিশাল জগত। তুই যখন নিরানব্বই ভাগ কাজ করছিস, তখন তোর মতো আরও হাজারো মানুষ একই কাজ করছে। তাহলে আলাদা হবি কীভাবে? এই শেষ এক ভাগেই লুকিয়ে আছে তোর অনন্যতা

হাবিব একে একে শিশিরের অনলাইন ব্যবসার খুঁটিনাটি জানতে চাইল। শিশিরের পণ্যের বিবরণ, ছবি, প্রচারের পদ্ধতি, গ্রাহকদের সাথে যোগাযোগের ধরন,সবকিছু মন দিয়ে শুনল। তারপর সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিল:

  • গ্রাহক অভিজ্ঞতা: তুই কি কখনো ভেবে দেখেছিস, তোর গ্রাহকরা কী চায়? শুধু ভালো পণ্য দিলেই হবে না, তাদের একটা অসাধারণ অনলাইন শপিংয়ের অভিজ্ঞতা দিতে হবে। দ্রুত ডেলিভারি, সহজে রিটার্ন করার সুবিধা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাদের অভিযোগ বা সমস্যায় দ্রুত এবং আন্তরিকভাবে সাড়া দেওয়া, এগুলোই তোর ব্যবসাকে অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখবে।

  • পণ্যের গল্প: মানুষ এখন শুধু পণ্য কেনে না, তারা গল্প কেনে। তোর পণ্যের পেছনে কী গল্প আছে, কেন তুই এই পণ্যগুলো বেছেছিস, এই পণ্যগুলো তাদের জীবনে কী পরিবর্তন আনতে পারে, এই গল্পগুলো তুলে ধর। মানুষকে তোর পণ্যের সাথে একটা উপকারী সম্পর্ক তৈরি করতে শেখা।

  • ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডিং: মানুষ তোর দোকান থেকে কেনার আগে তোকে বিশ্বাস করতে চাইবে। তুই কেমন মানুষ, তোর সততা কতটা, এগুলো মানুষ জানতে চায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু পণ্য বিক্রি না করে, তোর নিজের একটা পরিচিতি তৈরি কর। টিপস দে, সমস্যার সমাধান দে, যা তোর ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবে। অনলাইনে শুধু পণ্য বিক্রি করলেই হয় না, কাস্টমারদের সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। তাদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানো, নতুন পণ্য এলে তাদের জানানো, এমনকি তাদের ব্যক্তিগত রুচি অনুযায়ী পণ্য সাজেস্ট করা এগুলো ছোট ছোট বিষয় হলেও কাস্টমারদের মনে তোর ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা তৈরি করবে।

  • ধারাবাহিক শেখা ও পরিবর্তন: অনলাইন জগৎ দ্রুত বদলায়। আজ যা চলছে, কাল তা নাও চলতে পারে। তাই নিয়মিত নতুন কিছু শেখার চেষ্টা কর। তোর প্রতিযোগীরা কী করছে, নতুন কী প্রযুক্তি আসছে, গ্রাহকদের চাহিদা কীভাবে বদলাচ্ছে এগুলো সম্পর্কে আপডেটেড থাক। তোর ব্যবসার মডেল প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে দ্বিধা করিস না।

হাবিবের কথাগুলো শিশিরের মনে গভীর প্রভাব ফেলল। সে বুঝতে পারল, এত দিন সে শুধু কাজের পরিমাণ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, কিন্তু কাজের গুণগত মান আর আধুনিক কৌশলগুলো নিয়ে সেভাবে ভাবেনি। সে যেটুকু করেছে, সেটাকে সে পরিপূর্ণ ভেবেছিল, কিন্তু আসল প্রতিযোগিতা যে বাকি এক শতাংশে, তা সে বুঝতে পারেনি।

শিশির নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করল। হাবিবের পরামর্শ অনুযায়ী সে তার অনলাইন শপের পুরো প্রক্রিয়াটি নতুন করে সাজাল। সে গ্রাহকদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা শুরু করল, তাদের ফিডব্যাক নিয়ে পণ্যের মান উন্নত করল। সে নিজের ব্র্যান্ডিংয়ের দিকে মনোযোগ দিল, পণ্যের পেছনের গল্পগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরল। ধীরে ধীরে তার অনলাইন শপ আবার নতুন করে গতি পেতে শুরু করল।

কয়েক মাস পর শিশিরের মুখে অনাবিল হাসি। তার ব্যবসা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো চলছে। লাভ হচ্ছে, গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারছে, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে এখন আর সেই "নিরানব্বইয়ের বাধা" দেখে ঘাবড়ে যায় না। সে জানে, শেষ এক শতাংশেই আসল চ্যালেঞ্জ আর সেই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করলেই আসে প্রকৃত সাফল্য।

শিশির হাবিবকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে বলল, তোর পরামর্শ না পেলে হয়তো আমি সেদিনই হাল ছেড়ে দিতাম। তুই আমায় শিখিয়েছিস যে, নিরানব্বই ভাগ কাজ করার পর যে বাকি এক ভাগ থাকে, সেটাই আসল খেলা। সেখানেই হেরে গেলে সব পরিশ্রম বৃথা।

হাবিব হাসল। আসলে, উদ্যোক্তা হওয়াটা একটা নিরন্তর শেখার প্রক্রিয়া। যখনই মনে হবে তুই সব করে ফেলেছিস, তখনই বুঝবি তোর আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। এই শেষ এক শতাংশকে জয় করাই তোর সাফল্যের গল্প।

বি: দ্র: গল্পের চরিত্র কাল্পনিক, কারো সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ