Header Ads Widget


আমার আছে রেইনকোট - এমএস হাবিবুর রহমান

আমার সাংবাদিকতা শুরুর দিনগুলো ছিল এক নতুন চ্যালেঞ্জের মতো। একদিকে ছিল পেশার প্রতি অগাধ ভালোবাসা, অন্যদিকে ছিল বাস্তবতার কঠোর চিত্র। আমি বিশ্বাস করি, শুধু সংবাদ সংগ্রহ করে পত্রিকায় প্রকাশ করলেই ভালো সাংবাদিক হওয়া যায় না। এই পেশায় সফল হতে হলে প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা এবং অভিজ্ঞদের সান্নিধ্য। যখন সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম, তখন থেকেই আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার প্রয়োজন পরামর্শদাতা, যিনি আমাকে ঝড়-বৃষ্টির মতো কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে পারবেন। আমি পরামর্শদাতাকে 'রেইনকোট'-এর মতো মনে করি। সেই চিন্তা থেকেই আমি আমার সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিই। তাদের সম্মান দিয়ে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে শুরু করি।
এম এস হাবিবুর রহমান

প্রথমদিকে অনেকের কাছেই হয়তো আমার এই উদ্যোগ বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম, প্রতিটি সম্পর্কই এক একটি বিনিয়োগ। আমি সিনিয়রদের কাছ থেকে শুধু পেশাগত জ্ঞানই নয়, বরং জীবনের নানান দিক সম্পর্কেও পরামর্শ নিতাম। তাদের অভিজ্ঞতার গল্পগুলো মন দিয়ে শুনতাম, তাদের ভুল থেকে শিখতাম। ধীরে ধীরে, সিনিয়র সাংবাদিকরা আমার এই আগ্রহ এবং শেখার মানসিকতায় মুগ্ধ হন। তারা আমাকে নিজেদের ছোট ভাইয়ের মতো দেখতে শুরু করেন।

যখন কোনো বড় খবর আসে, আমি সবার আগে আমার সিনিয়রদের সাথে আলোচনা করি। তাদের মতামত নিই, তাদের পরামর্শ মেনে চলি। এই অভ্যাস আমাকে অনেক ভুল করা থেকে বাঁচিয়ে দেয়। আমার প্রতিবেদনগুলো আরও তথ্যবহুল এবং নির্ভুল হতে শুরু করে।

আমার সাংবাদিকতার যাত্রা আমাকে শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে শেখায়নি, বরং সমাজের প্রতি আমার দায়বদ্ধতাকেও আরও বাড়িয়ে দেয়। যখন আমি জানতে পারলাম, কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবার মান খুবই করুণ। সারাদেশের ৪৯২টি হাসপাতালের মধ্যে সেবার মানের দিক দিয়ে ৩০০-এরও নিচে ছিল তার অবস্থান। রোগীদের দুর্দশা আর অব্যবস্থাপনার খবর আমার কানে আসতে শুরু করল। আমার সাংবাদিক সত্তা জেগে উঠল। সিনিয়র সাংবাদিকদের সহযোগিতায় আমি তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। তাদের অভিজ্ঞ চোখ আর নির্মোহ যুক্তি আমাকে পথ দেখাল। 'নিউজ সমাহার' সহ দশ-বারোটি পত্রিকায় একের পর এক অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশিত হতে লাগল। প্রতিটি সংবাদ ছিল যেন এক-একটি জলবিন্দু, যা জমে জমে এক প্রবল স্রোত তৈরি করছিল।

এই সংবাদের জের ধরে তৎকালীন সময়ে "নিউজ সমাহার"-এর বার্তা সম্পাদক হাজী সাইফুল ইসলাম এবং সম্পাদক ও প্রকাশক এম এস হাবিবুর রহমানকে (আমাকে) হাসপাতালের আরএমও আইনি নোটিশ পাঠান। পরে মামলাও হয়...।

কিন্তু আমি আমার সিনিয়রদের পরামর্শে এবং নিজের দৃঢ়তায় অবিচল থাকি। এই সংবাদগুলোর ভিত্তিতে এগিয়ে এলেন গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য বঙ্গতাজ কন্যা সিমিন হোসেন রিমি। তাঁর আন্তরিক পদক্ষেপ আর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিতে কাপাসিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভাগ্য বদলাতে শুরু করল। একসময় সারাদেশে ৩০০-এর নিচে থাকা হাসপাতালটি ২০২৩ সালের ১লা মে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত ফলাফলে ৪৯২টি হাসপাতালের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করল। এটি ছিল আমার জন্য এক বিশাল অর্জন, যা প্রমাণ করে সঠিক সময়ে, সঠিক মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করলে কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এই অর্জন শুধু একটি হাসপাতালের নয়, এটি সৎ সাংবাদিকতা এবং সঠিক নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু জাফর সাহেব ফোন করলেন আমাকে। কন্ঠস্বরে উদ্বেগ, "আমাদের এক মহিলা সাংবাদিক ঢাকা থেকে রওনা হয়ে কিশোরগঞ্জ যাবে, এখন রাজেন্দ্রপুর আছে। ওকে একটু সহযোগিতা করতে হবে।"

আমি এক মুহূর্তও দেরি করলাম না। কাপাসিয়া প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক, আমার প্রিয় সিনিয়র সাংবাদিক মো. বেলায়েত হোসেন শামীম ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। শামীম ভাইও ছিলেন আমার এক বিশ্বস্ত 'রেইনকোট'। তিনি দ্রুত বিষয়টির সমাধান করে দিলেন। সেই দিন, ঘূর্ণিঝড় 'আমফান'-এর প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও একজন অজানা সাংবাদিককে সাহায্য করার যে মানসিক শান্তি আমি পেয়েছিলাম, তা ছিল অমূল্য। এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আমি আমার লেখা "আমফান ভালোবাসার স্নান!" শিরোনামের সংবাদে লিখেছিলাম, কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে।

এই ঘটনা আবারও আমাকে শিখিয়েছিল যে চলার পথে যখন অপ্রত্যাশিত ঝড়-ঝাপটা আসে, তখন একজন অভিজ্ঞ ও সহৃদয় পরামর্শদাতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বেলায়েত হোসেন শামীম ভাই সেদিন সেই মহিলা সাংবাদিক এবং পরোক্ষভাবে আমার জন্য এক সত্যিকারের 'রেইনকোট' হয়ে উঠেছিলেন।

এমন ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে বারবার প্রমাণ স্বরুপ ভেসে উঠে যে, সাংবাদিকতা শুধু সংবাদ সংগ্রহ আর প্রকাশ নয়, এটি একটি বৃহৎ পরিবার। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়ায়, একে অপরের 'রেইনকোট' হয়ে ওঠে। জীবনের চলার পথে এমন সু-পরামর্শদাতা থাকলে, সত্যিই সহজে একটি সুন্দর জীবনযাপন করা সম্ভব।

আমার এই গল্পের উদ্দেশ্য আমাদের দেশে সিনিয়র-জুনিয়র সাংবাদিকের সু-সম্পর্কের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরা। জীবনে সফল হতে হলে শুধু নিজের যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সঠিক পথপ্রদর্শক এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। রেইনকোট যেমন বৃষ্টি থেকে আমাদের রক্ষা করে, তেমনি একজন ভালো পরামর্শদাতা ও শুভাকাঙ্ক্ষী জীবনের ঝড়-ঝাপটা থেকে আমাদের বাঁচিয়ে একটি সুন্দর জীবনযাপন করতে সাহায্য করেন।

আপনার কি মনে হয়, আমাদের জীবনে এমন "রেইনকোট" থাকাটা জরুরি?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ