Header Ads Widget


দুর্যোগকালে অনলাইন শিক্ষা ও গবেষণা- বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট



সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই জ্ঞান অর্জনের পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের (খ্রি.পূ. ৪৬৯-৩৯৯) সময় থেকেই জ্ঞান বা শিক্ষাপিপাসুদের হতে হয়েছে নানারকম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন। জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস। কখনো কখনো রাজনৈতিক আন্দোলন কিংবা ষড়যন্ত্র আবার কখনো কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। আজ আমরা সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে উত্তরাধুনিক যুগে উপনীত হয়েছি এই শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তির কল্যাণে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিও আমাদের দাঁড় করিয়েছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সারা বিশ্বের এই অসহায়ত্ব অবস্থা এটাই ভাবায় যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আরো বাস্তবমুখী ও সময় উপযোগী হওয়া এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিংয়ের বিষয়ে। একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কোনো স্থান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার প্রক্রিয়াকে ই-লার্নিং বলা হয়ে থাকে। ই-লার্নিংয়ের ৮০ শতাংশের বেশি পাঠ কার্যক্রম ইন্টারনেটনির্ভর। তাই একে ‘ডিসট্যান্ট লার্নিং’ও বলা হয়। এতে গতানুগতিক ধারায় শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থেকে পাঠদান কিংবা পাঠগ্রহণ করতে হয় না। ই-লার্নিংয়ের বেশকিছু ভালো দিক আছে। প্রথমত, এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা যে কোনো স্থান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে। তাকে কষ্ট করে আর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আসতে হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, যারা চাকরির পাশাপাশি লেখাপড়া করতে চায় তাদের জন্য সুবিধা হচ্ছে তারা যে কোনো সময় শিক্ষামূলক ভিডিওগুলো দেখে নিজের সুবিধামতো সময়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। তাছাড়াও কোনো টপিক বুঝতে সমস্যা হলে পুনঃপুন প্লে করে দেখে নিতে পারছেন। মানুষ নানাভাবে খুব সহজেই শিক্ষা লাভ করতে পারবে।
করনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে আসা যাক। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে সমগ্র পৃথিবী এখন যেন স্থির হয়ে আছে। একটা যুদ্ধাবস্থা দেশে দেশে। থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল, কলেজ ও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। UNESCO-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৩০টি দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটি আরো বাড়তে পারে। যার ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। এদিকে এই অচল অবস্থা বিরাজ করছে মাসের পর মাস, পৃথিবীব্যাপী। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নিতে পারছে না। আর শিক্ষক পারছে না শিক্ষা প্রদান করতে। জীবন তো আর থামিয়ে রাখা যায় না। ঠিক সেভাবেই শিক্ষা কার্যক্রমও থেমে থাকা উচিত নয়।
যেহেতু সবাই বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে সেক্ষেত্রে বাড়িতে বসেও শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশেও স্বল্প ব্যাপ্তিতে অনলাইনে শিক্ষা প্রদান কর্মসূচি চলছে । বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ‘Zoom Application’ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষকরা অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবেন। এক্ষেত্রে বিডিরেন (বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক) সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করবে। এই প্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ক্লাস লেকচারের পাশাপাশি ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে এবং নিজের মতামতও প্রকাশ করতে পারছে।
বাংলাদেশে ই-লার্নিংয়ের চর্চা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুরু হয়নি এখনো। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট বোদ্ধারা ই-লার্নিংয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে, যার বেশির ভাগই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনো এ ধরনের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে প্রায় সব ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লেখাপড়ায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এগিয়ে। তাই তাদের পক্ষে ই-লার্নিংয়ের ব্যাবস্থা করা কঠিন নয়।
চীনের উহানে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে লকডাউন পরিস্থতি বিরাজ করছিল তখন উহানের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় বাড়িতেই ক্লাস নেওয়া হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষকের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পেরেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে চীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। চীনের Zhejiang University দুই সপ্তাহের মধ্যেই ৫ হাজারেরও বেশি কোর্স অনলাইনভিত্তিক করে ফেলতে সক্ষম হয়।
Zhejiang University তাদের সব শিক্ষার্থীকে এই ই-লার্নিং পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসে। বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই সুযোগ লাভ করে, এমনকি কিছু কোর্স বিশ্বব্যাপী সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি কোর্স হাবের ব্যবস্থা করে, যা ৫ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষকে আকৃষ্ট করে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি ‘Ding Talk ZJU’ নামক একটি অ্যাপ তৈরি করে, যা প্রায় ৩ লাখ মানুষকে আকৃষ্ট করে। সমস্যা তবুও থেকেই যায় কারণ অনেক শিক্ষকই প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ নয়। আর তাই ZJU ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে ৩ হাজার ৬৭০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। শুধু তা-ই নয়, প্রায় ১ হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীকে এই ডিসট্যান্স এডুকেশনের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন ইন্টারনেটসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিতে কম খরচে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টরনেটসেবা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সঙ্গে শিক্ষার্থীরা প্লে ব্যাক এবং কোর্স ওয়্যার প্যাকেজ পাচ্ছে, যার মাধ্যমে কোনো লেকচার ফলো না করতে পারলেও পরবর্তী সময়ে সহযোগিতা পেতে পারে। ZJU তাদের অনলাইন শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল স্মার্ট ক্যাম্পাস তৈরির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে তাদের অনলাইনে পাঠদানের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে ZJU নতুন প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা আরো বৃহত্ পরিসরে করতে শুরু করে। সম্প্রতি ২০০ স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা তারা করেছে যেখানে সহজেই শিক্ষকের ক্লাসরুমের পাঠদানের ভিডিও ধারণ এবং সরাসরি অনলাইনে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
অনলাইন শিক্ষার মতোই গবেষণামূলক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আজ পৃথিবীর অনেক রহস্যই আমাদের জানা শুধু কিছু নিবেদিতপ্রাণ গবেষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেধার কারণেই। তথ্য প্রযুক্তিতে যেমন মানুষ উত্কর্ষ লাভ করেছে তেমনি চিকিত্সাক্ষেত্রেও এনেছে আমূল পরিবর্তন। এখন আর কলেরা বা ফ্লুতে মানুষ ঐ মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, যতটা কয়েক শত বছর আগে দেখা যেত।
বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। তবে যেদিন এ দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে আসবে কেবল সেদিনই প্রযুক্তির দিক থেকে সত্যিকারের উত্কর্ষ লাভ করা সম্ভব হবে। তবু আশার কথা হচ্ছে এখন এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের কিছু মেধাবী ভেন্টিলেটর তৈরি এবং করোনা ভাইরাসের শনাক্তকরণ টেস্ট কিটও তৈরিতে আশার আলো ছড়াচ্ছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং ভবিষ্যতে আরো এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে, এটাই আশা করি।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে থেকে শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার। ঠিক যেভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্ব সহকারে অংশগ্রহণ করে থাকে, একইভাবে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও গুরুত্বসহকারে কাজ করা প্রয়োজন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের অঙ্গীকার হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম এবং প্রায়োগিক ও উদ্ভাবনী গবেষণায় আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক : প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ