পারিবারিক জীবন আমাদের সমাজের ভিত্তি হলেও, সম্প্রতি অনেক পরিবারেই অশান্তি ও বিরোধ প্রকট হয়ে উঠছে। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এসব বিরোধের মূল কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো যোগাযোগের অভাব । সময়মতো, খোলামেলা ও কার্যকর আলোচনা না হওয়ায় ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝিগুলোই রূপ নিচ্ছে বড় ধরনের পারিবারিক কলহে।
যোগাযোগের অভাব একটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। যখন পরিবারের সদস্যরা তাদের অনুভূতি, প্রত্যাশা, বা উদ্বেগের কথা একে অপরের কাছে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না, তখন ভুল ধারণা তৈরি হয়। এই ভুল বোঝাবুঝিগুলি ধীরে ধীরে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দেয়, যা যেকোনো মুহূর্তে বিরোধের জন্ম দিতে পারে।
কেন ঘটছে এই সমস্যা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যোগাযোগের এই অভাবের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে:
* প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার: স্মার্টফোন ও অন্যান্য গ্যাজেটে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের সাথে সরাসরি এবং মানসম্পন্ন সময় কাটাচ্ছে না। ফলে কথা বলার সুযোগ কমে যাচ্ছে।
* কর্মব্যস্ততা: বর্তমান যুগের তীব্র কর্মব্যস্ততা এবং জীবনযাত্রার চাপ অনেক পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করছে। দিনের শেষে ক্লান্তি বা সময়ের অভাবে অনেকে পারিবারিক আলোচনা এড়িয়ে চলেন।
* ভয়ের সংস্কৃতি: অনেক পরিবারে শিশুরা বা কনিষ্ঠ সদস্যরা তাদের মতামত বা সমস্যা প্রকাশ করতে ভয় পায়, কারণ তারা মনে করে তারা সমালোচিত হতে পারে বা তাদের কথা গুরুত্ব পাবে না।
* শ্রবণের অভাব: কেবল কথা বলা নয়, মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ (Active Listening)-এর অভাবও একটি বড় সমস্যা। একে অপরের কথা ধৈর্য সহকারে না শুনলে সমস্যার মূল কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না।
বিরোধের প্রভাব
এই ধরনের যোগাযোগহীনতা কেবল মানসিক অশান্তিই বাড়ায় না, এর গুরুতর সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রভাবও রয়েছে:
* মানসিক স্বাস্থ্য: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং মানসিক চাপ বাড়াতে পারে, বিশেষত শিশুদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
* সম্পর্কের অবনতি: দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ না হলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থেকে শুরু করে ভাই-বোনের সম্পর্ক পর্যন্ত দুর্বল হয়ে যায়, যা অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদ বা পরিবার ভেঙে যাওয়ার মতো চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছায়।
* শিশু-কিশোরদের আচরণগত সমস্যা: পরিবারে সুস্থ যোগাযোগের পরিবেশ না থাকলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে একগুঁয়েমি, জেদ, বা সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণার মতো আচরণগত সমস্যা দেখা যেতে পারে।
সমাধানের পথ
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে মনোবিজ্ঞানীরা কয়েকটি সহজ অথচ কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন:
* মানসম্পন্ন সময় দিন: প্রতিদিন অন্তত একবার পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বসার বা খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। এই সময়টিতে মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার না করে একে অপরের সাথে খোলামেলা কথা বলুন।
* সক্রিয়ভাবে শুনুন: যখন কেউ কথা বলছে, তখন তাকে বাধা না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনুন এবং তার অনুভূতিকে গুরুত্ব দিন।
* 'আমি' বিবৃতি ব্যবহার করুন: দোষারোপ বা সমালোচনা না করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে 'আমি' বিবৃতি ব্যবহার করুন (যেমন, "আমি কষ্ট পাই যখন...")।
* সমবেদনা দেখান: অন্য সদস্যের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের প্রতি সহমর্মী হন।
পারিবারিক বিরোধ এড়াতে কার্যকর যোগাযোগই হলো মূল চাবিকাঠি। পারিবারিক বন্ধন মজবুত করতে প্রতিটি সদস্যের উচিত নিজের দিক থেকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া এবং নিয়মিতভাবে, খোলামেলা ও সম্মানের সাথে একে অপরের সাথে কথা বলার অভ্যাস তৈরি করা।
0 মন্তব্যসমূহ