প্রতিবেদনের মূল বিষয়বস্তু এবং তার দৃষ্টিকোণ নিয়ে রিপোর্টার এবং সম্পাদকের একমত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্টোরি কীভাবে বানাতে হবে, কোন্ ফর্মাটে তা পরিবেশন করতে হবে এবং তার দৈর্ঘ্য কত হবে সে বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে রিপোর্টারকে স্বচ্ছ ধারণা কীভাবে দেবেন তা ব্যাখ্যা করেছেন বিবিসির ‘ফোকাস অন আফ্রিকা’-র প্রাক্তন সম্পাদক জোসেফ ওয়ারুঙ্গু ।

দ্বিতীয়ত, গল্পটার মূল বিষয়বস্তু নিয়ে কি সম্পাদক এবং রিপোর্টার একমত? যদি রিপোর্টার এবং তার সম্পাদক গল্পের মৌলিক বিষয় নিয়ে একমত না হন, তাহলে এই মতবিরোধ না মেটা পর্যন্ত প্রতিবেদন নিয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে না।
এখানে মনে রাখতে হবে, সম্পাদক বা লন্ডনে অনুষ্ঠান প্রযোজক শুধু একটি প্রতিবেদন নিয়ে ভাবছেন না। তাদেরকে কয়েকটি স্টোরি নিয়ে তৈরি গোটা অনুষ্ঠানের কথা মাথায় রাখতে হচ্ছে।
যার ফলে, সম্পাদক এবং প্রযোজক-এর দৃষ্টিভঙ্গি মাঠে রিপোর্টারের থেকে ভিন্ন হবে, যেহেতু রিপোর্টার শুধু মাত্র তার নিজস্ব প্রতিবেদনের খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।
ট্রিটমেন্ট
রিপোর্টার হয়তো হাজার হাজার মাইল দূরে। তাই গল্পটা কীভাবে বানাতে এবং পরিবেশন করতে হবে, অর্থাৎ তার ট্রিটমেন্ট কী হবে সে বিষয়ে রিপোর্টারের সাথে একমত হতে হবে।
কোন্ গল্পের কী ধরণের ট্রিটমেন্ট হওয়া উচিত এবং সেটা অনুষ্ঠানের কোথায় কীভাবে স্থান পাবে, সে বিষয়ে সম্পাদক বা প্রযোজক-এর পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
তারা হয়তো রিপোর্টারের সাথে উপস্থাপকের একটি আলোচনা বা টু-ওয়ে চাইবেন; অথবা অডিও ক্লিপসহ একটি প্রতিবেদন; অথবা ঘটনাস্থলের এ্যাম্বিয়েন্স, বর্ণনা ইত্যাদিসহ একটি প্যাকেজ।
ট্রিটমেন্ট যাই হোক, রিপোর্টারের পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার সম্পাদক কেন একটি নির্দিষ্ট পথে স্টোরিটি কভার করতে চাইছেন। রিপোর্টারের নিজেরও ট্রিটমেন্ট নিয়ে প্রস্তাব থাকতে পারে।
একটি ঘটনা বা গল্প সফলভাবে পরিবেশন করতে হলে প্রয়োজন ভাল যোগাযোগ এবং সমঝোতা।
দৈর্ঘ্য
প্রতিবেদনটি কত বড় হওয়া উচিত? মাথায় রাখতে হবে,এই প্রতিবেদন অনুষ্ঠানের একটি অংশ হবে, কাজেই সেটা একটি নির্দিষ্ট সময়ের হবে – যেমন, দুই মিনিট। অর্থাৎ, এখানে দশ মিনিটের একটি রিপোর্ট পাঠানোর কোন মানেই থাকবে না।
প্রতিবেদন কোন্ অনুষ্ঠানের কোথায় যাবে সেটা বিবেচনা করতে হবে। এটা কি আগামী সপ্তাহে যাবে? নাকি সপ্তাহান্তে? আর অনুষ্ঠানের কোথায় এই প্রতিবেদন প্রচার করা হবে?
এই প্রতিবেদন কি দিনের প্রধান খবর বা লিড স্টোরি? নাকি এটা একটি হাল্কা গল্প? রিপোর্টারকে সেটা জানতে হবে, কারণ সেটাই নির্ধারণ করবে সে কীভাবে প্রতিবেদন তৈরি করবে।
এই প্রতিবেদন কি একক একটি গল্প? নাকি একটি ঘটনা নিয়ে কতগুলো প্রতিবেদন নিয়ে সিকুয়েন্স-এর একটি অংশ – যেমন, কোন বড় স্পোর্টস টুর্নামেন্ট-এ অংশগ্রহণকারী একটি দেশ নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন?
এই সব কিছু সম্পাদক এবং রিপোর্টার-এর মাধ্যমে আলোচনা করে নিশ্চিত করা উচিত।
রিপোর্টার: পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিন
যদি সম্পাদক এবং প্রযোজক জানেন তারা কী চাইছেন, তাহলে রিপোর্টারেরও উচিত পরিষ্কার বুঝে নেয়া প্রতিবেদনটি ঠিক কীভাবে তৈরি করতে হবে।
স্টোরির সব খুঁটিনাটি বুঝে নেয়া রিপোর্টারের দায়িত্ব। রিপোর্টারকে গল্পের সঠিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে হবে এবং এই স্টোরি সংক্রান্ত যে কোন নতুন খবরের গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হতে হবে।
আপনি আপনার গল্প সম্পর্কে যতটুকু জানবেন, আপনার সম্পাদক বা প্রযোজক অতটুকু জানবে, তা প্রত্যাশা করবেন না। তারা যদি পরিস্থিতির গুরুত্ব ঠিক উপলব্ধি না করতে পারেন, বা বুঝতে না পারেন কীভাবে এই গল্প সার্বিক পরিস্থিতির জন্য প্রাসঙ্গিক, তাহলে আপনাকেই বিষয়টি বোঝাতে হবে এবং জোরালো তর্ক করতে হবে।
প্রতিবেদন কমিশন একটি অংশীদারিত্বমূলক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। যেসব সম্পাদক বা প্রযোজক গোঁয়ার্তুমি করেন, তাদের কারণে অনেক সময় ভাল স্টোরি হাতছাড়া হয়ে যায়।
ট্রিটমেন্ট: রিপোর্টারের মতামত
একটি স্টোরি কীভাবে পরিবেশন করতে হবে, সে ব্যাপারে সম্পাদক এবং প্রযোজক-এর নিজস্ব ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় রিপোর্টাররাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
গল্পটিকে কীভাবে শ্রোতাদের কাছে ফুটিয়ে তোলা যাবে সে ব্যাপারে ঘটনাস্থলে যে সাংবাদিক আছেন, তার নিজস্ব ধারণা থাকবে ।
প্রতিবন্ধকতা
স্টোরিটি কীভাবে কভার করতে হবে সে ব্যাপারে শুরু থেকেই আপনাকে মনস্থির করতে হবে; কত সময় লাগবে; আর এই প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
প্রায়ই দেখা যাবে, প্রযুক্তি নিয়ে সমস্যার কারণে রিপোর্টার সময় মত প্রতিবেদন পাঠাতে পারছেন না, যার ফলে অনুষ্ঠানের প্রযোজকরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবেন। কাজেই:
সম্পাদক বা প্রযোজকগণ - ধৈর্য ধরুন।
রিপোর্টার - বিকল্প পরিকল্পনা বা ‘প্ল্যান বি’ হাতে রাখুন।
‘’যদি স্যাটেলাইট লাইন পড়ে যায়, তাহলে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কী করবো। বিকল্প ব্যবস্থায় অডিও ভাল মানের নাও হতে পারে। কাজেই, প্রযোজকদের পরিস্থিতি ভাল মত উপলব্ধি করতে হবে, যাতে তারা টেলিফোনে ‘তোমরা কোথায়, তোমাদের খুঁজে পাচ্ছি না’ বলে চিৎকার করতে না থাকে।’’
‘প্ল্যান বি’
এমনকি সব চেয়ে নিখুঁত পরিকল্পনাও ভেস্তে যেতে পারে। সেজন্যই আপনার একটি বিকল্প পরিকল্পনা প্রয়োজন।
যেমন, রিপোর্টার যদি সময়মত নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে কি সে তার সাথে মোবাইল ফোনে একটি সোজা-সাপটা টু-ওয়ে করতে পারবে? একেবারে কিছু না থাকার চেয়ে মোবাইল ফোনে টু-ওয়ে উত্তম।
অন্তত আমরা মূল খবরটি প্রচার করতে পারবো – যে, সেখানে সেতুটি ভেঙ্গে গেছে এবং আশে-পাশের এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
আপনি অবশ্য দিনের পরের দিকের অনুষ্ঠানের জন্য আরো বিস্তারিত প্যাকেজ তৈরি করতে পারেন – স্থানীয় লোকজন, উদ্ধারকারী দল সবার সাথে কথা-বার্তা বলে।
ব্যুরো
বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বিবিসির ব্যুরো আছে। এই ব্যুরোগুলোর বেশ কয়েকটায় কমিশনার আছেন – যাদের ‘কোর কমিশনার’ বলা হয়, যারা লন্ডনে সম্পাদকদের পক্ষ হয়ে রিপোর্টারদের কাছ থেকে স্টোরি কমিশন করেন।
রিপোর্টাররা যাতে বোঝেন লন্ডন কী চাইছে এবং সম্পাদকরা যাতে উপলব্ধি করতে পারেন রিপোর্টাররা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে কাজ করে, সেটা আঞ্চলিক ব্যুরো নিশ্চিত করে।
‘কোর কমিশনার’
লন্ডনে প্রযোজকদের মত ব্যুরোগুলোর কোর কমিশনারদেরও ভাল ভাবে গুছিয়ে কাজকর্ম করতে হয়।
কাজেই আপনি যদি বিবিসির নাইরোবি, দিল্লি বা মায়ামি ব্যুরোতে কোর কমিশনার-এর দায়িত্ব পালন করেন, তখন মনে রাখবেন আপনার কাজ শেষে অন্য যে সহকর্মী আসছেন, তার জন্য সব কিছু বুঝিয়ে হ্যান্ড-ওভার করে যেতে হবে।
একজন কোর কমিশনার সব কিছু সম্পাদক, রিপোর্টার এবং ব্যুরোতে তার পরের শিফটের কোর কমিশনারকে ভাল মত বুঝিয়ে দিয়েছে কি না, তার উপর একটি স্টোরি কমিশনের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে।
কাজেই, সব সময় নোট নেবেন, সব তথ্য গুছিয়ে রাখবেন এবং হ্যান্ড-ওভার করবেন এবং অবশ্যই একটি ‘প্ল্যান বি’ রাখবেন।
খোলা মন
মনে রাখবেন, ঘটনাস্থল থেকে আপনি অনেক দূরে। রিপোর্টার সেখানে আছে, আপনি সেখানে নেই। আপনার দিক থেকে প্রস্তাব থাকবে, যেটাতে রিপোর্টারের অবদান এবং মতামত থাকবে।
দিনের শেষে অনুষ্ঠানের দায়-দায়িত্ব সম্পাদকের, কাজেই কিছু সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার সময় রিপোর্টার কী বলছেন, সেটা বিবেচনায় নেয়া উচিত।
কোন কোন সময় মতবিরোধ এবং উত্তেজনা থাকতে পারে, কিন্তু রিপোর্টার এবং সম্পাদক একই লক্ষ্যে কাজ করছেন: তাদের শ্রোতাদের জন্য উঁচু মানের অনুষ্ঠান পরিবেশনা করা।
আলোচনাই এখানে সাফল্যের চাবি-কাঠি।
0 মন্তব্যসমূহ