Header Ads Widget


সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি ঋতুভিত্তিক পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস

প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের শরীরেরও পরিবর্তন ঘটে। আর তাই সুস্থ থাকতে ঋতু অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন ইউনানী, আয়ুর্বেদ, এবং আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞান এই ধারণাকে সমর্থন করে। এমনকি হোমিওপ্যাথিও ঋতুভিত্তিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে গুরুত্ব দেয়।

পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস

ইউনানী মতে ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস

ইউনানী চিকিৎসাবিদ্যা শরীরের চারটি মেজাজ বা টেম্পারামেন্টের (দমভী, বালগমি, সাফ্রাভি, ও সুদাবী) এবং চারটি মৌলিক গুণের (তাপ, ঠান্ডা, শুষ্কতা, আর্দ্রতা) ভারসাম্যের উপর জোর দেয়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এই গুণগুলির প্রভাব শরীরে পরিবর্তিত হয়।

ইউনানী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঋতু অনুযায়ী খাবার গ্রহণ করলে শরীরের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বজায় থাকে। যেমন, গ্রীষ্মকালে যখন পরিবেশ উষ্ণ ও শুষ্ক থাকে, তখন শরীরকে ঠান্ডা ও আর্দ্র রাখতে প্রচুর পরিমাণে জলীয় ফল যেমন আম, জাম, তালশাঁস, লিচু, তরমুজ, ডাব এবং হালকা খাবার যেমন ভাত, রুটি, মুগডাল, সবুজ শাকসবজি উপকারী। শীতকালে শরীরের তাপমাত্রা কম থাকে, তাই ক্যালরিযুক্ত এবং উষ্ণ খাবার যেমন মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, বিভিন্ন প্রকার শাক ও সবজি যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, মেথি শাক ইত্যাদি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়।

আয়ুর্বেদ মতে ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস

আয়ুর্বেদে 'ঋতুচর্যা' নামে একটি ধারণা আছে, যেখানে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্য ও জীবনধারার পরিবর্তনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এটি শরীরের তিনটি দোষ (বাত, পিত্ত, কফ) ভারসাম্যে রাখতে সাহায্য করে।

আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে যা আমাদের শরীরের উপর প্রভাব ফেলে।

  • গ্রীষ্মকাল: এই ঋতুতে শরীরকে শীতল রাখতে হালকা, জলীয় এবং মিষ্টি স্বাদের খাবার যেমন ফল, সবজি, শসা, নারকেলের জল, লাউ, করলা ইত্যাদি গ্রহণ করা উচিত। অতিরিক্ত মশলাযুক্ত, তৈলাক্ত এবং ভাজা খাবার পরিহার করা ভালো।
  • বর্ষাকাল: বর্ষায় হজম শক্তি দুর্বল থাকে। তাই হালকা, সহজে হজম হয় এমন গরম খাবার যেমন স্যুপ, খিচুড়ি, আদা, গোলমরিচ ব্যবহার করে রান্না করা খাবার উপকারী।
  • শীতকাল: এই সময় শরীরকে উষ্ণ ও শক্তিশালী রাখতে পুষ্টিকর এবং উষ্ণ খাবার যেমন ঘি, দুধ, বাদাম, তিল, মূল জাতীয় সবজি, মশলাযুক্ত খাবার (আদা, দারচিনি) গ্রহণ করা উচিত।

আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, ঋতুভিত্তিক খাবার গ্রহণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হজম শক্তি উন্নত করে এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। (সূত্র: Netmeds, The Nattika Beach Resort)

হোমিওপ্যাথি ও ঋতুভিত্তিক স্বাস্থ্য

হোমিওপ্যাথি সরাসরি ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নির্দিষ্ট নির্দেশিকা না দিলেও, এটি ব্যক্তিগত অসুস্থতা এবং ঋতু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট শারীরিক লক্ষণগুলির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা প্রদান করে। হোমিওপ্যাথরা বিশ্বাস করেন যে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ।

তারা ঋতু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সর্দি-কাশি, অ্যালার্জি, হজমের সমস্যা ইত্যাদির জন্য নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ঔষধের পরামর্শ দেন। উদাহরণস্বরূপ, বসন্তকালে যখন অ্যালার্জির প্রবণতা বাড়ে, তখন অ্যালার্জির উপশমে কিছু নির্দিষ্ট ঔষধ ব্যবহার করা হয়। শীতকালে ঠান্ডা লাগা বা ফ্লুর জন্য Aconitum, Bryonia-এর মতো ঔষধ ব্যবহৃত হয়। মূল কথা হলো, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে আসা স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হোমিওপ্যাথি শরীরকে নিজস্ব নিরাময় ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। (সূত্র: ABP Live, Homeopathy Canada)

পুষ্টিবিদদের মতে ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস

আধুনিক পুষ্টিবিদরাও ঋতুভিত্তিক খাবারের গুরুত্বের উপর জোর দেন। তাদের মতে, যখন কোনো ফল বা সবজি তার নিজস্ব ঋতুতে উৎপাদিত হয়, তখন তা সবচেয়ে বেশি পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু হয়।

পুষ্টিবিদরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি তুলে ধরেন:

  • সর্বোচ্চ পুষ্টি: ঋতুভিত্তিক ফল ও সবজিতে ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সর্বোচ্চ মাত্রায় থাকে। কারণ এগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে সঠিক সময়ে পরিপক্ক হয়।
  • হজম সহজ: ঋতুভেদে উৎপাদিত খাদ্য আমাদের শরীরের তৎকালীন চাহিদা পূরণে সক্ষম। যেমন, গ্রীষ্মে প্রচুর জলীয় ফল শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে এবং শীতে উষ্ণ খাবার শরীরকে গরম রাখে।
  • স্থানীয় ও তাজা: ঋতুভিত্তিক খাবার সাধারণত স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, যা সতেজতা নিশ্চিত করে এবং পরিবহন খরচ কমায়। এর ফলে খাবারের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
  • পরিবেশগত সুবিধা: ঋতুভিত্তিক খাদ্য গ্রহণ পরিবেশের উপর চাপ কমায়, কারণ এটি গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করে।

পুষ্টিবিদ ইসরাত জাহান উল্লেখ করেন যে, নির্দিষ্ট ঋতুতে উৎপন্ন শাক-সবজি, যেমন বর্ষাকালে পাট শাক, পেটের সমস্যার জন্য খুবই উপকারী হতে পারে, কারণ এই সময়ে পেটের সমস্যা বেশি দেখা যায়। (সূত্র: Culina Health, Healthline, The Daily Star Bangla)

ইউনানী, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি এবং আধুনিক পুষ্টিবিদ্যা প্রতিটি স্বাস্থ্যচর্চাই ঋতুভিত্তিক খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব স্বীকার করে। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা কেবল সুস্থ থাকার চাবিকাঠি নয়, বরং এটি একটি সুষম জীবনধারা গড়ে তোলারও উপায়। তাই, আসুন আমরা ঋতু অনুযায়ী নিজেদের খাবারের তালিকা সাজাই এবং সুস্থ জীবনের পথে এগিয়ে যাই।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ