Header Ads Widget


করোনাভাইরাসে শিক্ষকদের দায়িত্ব


বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মানুষ আজ করোনাভাইরাস নামের এক অদৃশ্য অনুজীবের বিরুদ্ধে লড়াইরত অবস্থায় অধীর আগ্রহে কান পেতে আছে কবে এর কার্যকর প্রতিবিধান মিলবে। প্রতিরোধের মোক্ষম ওষুধ অথবা পন্থার সন্ধান পাওয়া যাবে। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষই জিতবে। ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো, উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষ এখন অনেক কাছাকাছি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের আতঙ্কে গোটা বিশ্ব যখন কাঁপছে তখন দেশে দেশে বৈরী ভাব কিছুটা হলেও কমে এসেছে। চিরশত্রু এখন বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে পিছপা হচ্ছে না।
মানুষ প্রতিরোধ সংগ্রামে এখন আশ্রয় খুঁজতে চাইছে প্রযুক্তির। তিউনিশিয়ায় লকডাউনে রোবট পুলিশ টহল দিচ্ছে। চিকিৎসকের বিকল্প হিসেবে রোবট চিকিৎসা কর্মকাণ্ডে সহায়তা করছে। মোহাম্মদ নজাবত আলী কোন মতে বিশ্বাসী, কোন সংগঠন করেন, আমার জানা নেই। তবে একটি পত্রিকার কলামে তিনি যা লিখেছেন তার মূল্য অপরিসীম। তিনি লিখেছেন, কোনো রোগব্যাধি মহামারী চিরস্থায়ী নয়, করোনাও একদিন থেমে যাবে; তবে কিছু সময় লাগতে পারে। এটি সামগ্রিক দিক থেকে সাময়িকভাবে শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করলেও এদেশের শিক্ষাপ্রিয় শিক্ষার্থীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। ইচ্ছাই বড় শক্তি। তারা ঘরে বসেই শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার এই স্কুল শিক্ষককে আমি শ্রদ্ধা জানাই।
এদিকে এ দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষকরা ভূমিকা রাখছেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে শিক্ষকরা একদিনের বেতন দেবেন। করোনা মোকাবেলায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক কর্মচারীদের বৈশাখী ভাতার ২০ শতাংশ প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, যার পরিমাণ চব্বিশ কোটি টাকা।
ইতিমধ্যে একজন শিক্ষক নেতার বরাত দিয়ে পত্রিকার খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেশের এ ক্রান্তিকালে আমরা দেশের মানুষের সঙ্গে রয়েছি। আমাদের বেতন-ভাতার একটি অংশ যদি করোনা মোকাবেলার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয় আমরা তাতে অনীহা দেখি না। আমরা রাজি আছি। এ বক্তব্য অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে আমার কথা ভিন্ন। সরকার বা কর্তৃপক্ষ চাওয়ার আগে স্বপ্রণোদিত হয়ে শিক্ষকদের পক্ষে শিক্ষক সংগঠনগুলো উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে বলে আমি আশা করি। কারণ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় কর্মসূচিতে শিক্ষকরা অতীতে যেমন ভূমিকা পালন করেছেন, এখনও তারা তা করবেন বলে আশা করি।
সারা বিশ্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কোটি কোটি শিক্ষার্থী যখন বাসগৃহে আবদ্ধ তখন তাদের শিক্ষাজীবন কীভাবে সচল রাখা যায় তা নিয়ে একের পর এক উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের দেশও পিছিয়ে নেই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে সংসদ অধিবেশন প্রচারকারী চ্যানেল গত ২৫ মার্চ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ঘরে স্কুল কর্মসূচিতে ধারণকৃত পাঠদান পরিচালনা করছে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্যও একই ধরনের কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা।
টেলিভিশনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কর্মসূচির টেকনিক্যাল মান কেমন, শিক্ষার্থীরা তা কীভাবে গ্রহণ করছে, এসব নিয়ে আলোচনার অবকাশ থাকলেও এখন তা নিয়ে সমালোচনা পরিহার করে এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো দরকার। নিউইয়র্কের ফোর্টহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক কামরুল হুদা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন- ১. প্রচলিত পাঠদান ব্যবস্থায় পরিবর্তন অনস্বীকার্য, ২. শিক্ষার্থীদের শিক্ষা চাহিদা পূরণে আমাদের মিলিত উদ্যোগে খুঁত বা ঘাটতি থাকলেও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের তা মেনে নিতে হবে।
ইউনেস্কোর ব্যাংকক কেন্দ্র ই-মেইলে আমাকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির তথ্য ও তথ্যচিত্র পাঠিয়ে আসছে নিয়মিত। এর মধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থী যে স্কুলে পড়ে, অনলাইনে সে স্কুলের পাঠদান কর্মসূচি এবং বিভিন্ন শিক্ষা উন্নয়ন একাডেমি বা প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ধরনের কর্মসূচি। দেড়শ’রও বেশি দেশের শিক্ষক সংগঠন নিয়ে গঠিত এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল (ইআই) শিক্ষকদের ও তাদের জন্য করণীয় নিয়ে কয়েকদিন আগে নির্দেশনা প্রচার করেছে। সেখানে শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী করোনার আগ্রাসন মোকাবেলায় শিক্ষক ও তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের সম্ভাব্য কার্যকলাপের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
বৈশ্বিক দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্র্থীরা সহায়ক নানা কর্মসূচি নিয়েছে। কয়েকটি জেলায় নারী শিক্ষকদের সৃজনধর্মী উদ্যোগের খবর যেমন মাস্ক তৈরি করে পরিবেশন এবং দুস্থদের খাবার সরবরাহের মতো সংবাদও রয়েছে। শিক্ষক সংগঠনের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠনের আঞ্চলিক শাখার সদস্যরা মাস্ক ও খাদ্যদ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করছেন। তবে জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষক সংগঠনের কর্মসূচি এখন পর্যন্ত আমার খুব একটা চোখে পড়েনি।
শিক্ষক সংগঠনগুলো অতীতে জাতীয় দুর্যোগে দায়িত্ব পালন করেছেন। আশা করি এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা দরকার। শিক্ষকদের মধ্যে যারা ন্যূনতম আর্থিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, যেমন এমপিও, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ। এমপিওভুক্তরা এমপিওবঞ্চিত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসতে পারেন। অর্থাৎ তাদের নিজেদের বেতন থেকে তাদের সহায়তা দিতে পারেন। সেই সঙ্গে ন্যূনপক্ষে একদিনের বেতন প্রদানে এগিয়ে আসতে পারেন।
শ্রেণিকক্ষে না থেকেও শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারেন, তার জন্য গুগল ১০ মিলিয়ন ডলারের স্কুলশিক্ষণ তহবিল গঠন করেছে। টিচ ফ্রম হোম এবং গুগল ফর এডুকেশন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণ অব্যাহত রাখতে ইউনেস্কো ইন্সটিটিউট ফর ইনফরমেশন টেকনোলোজি ইন এডুকেশনের সমর্থন ও সহায়তায় এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে করোনা মহামারীর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ২৫ মার্চের পর এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন দেশের সরকারের উদ্দেশে যে বারো দফা সুপারিশ দিয়েছে, তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল- বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালে শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রাখতে সরকারের উচিত শিক্ষক ও তাদের সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে কর্মসূচি গ্রহণ।
বিশেষ করে পেডাগোজি, ডিজিটাল উপকরণ ও প্লাটফর্ম বা মাধ্যম নির্ধারণে তাদের যুক্ত করা। দেশের শিক্ষকদের একদিনের বেতন কর্তন সংক্রান্ত সরকারির সিদ্ধান্তের আগেই শিক্ষক সংগঠনগুলোর উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়া। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে লেখাপড়া করানোর কর্মসূচিতে শিক্ষক সংগঠনগুলোকে যুক্ত করার প্রস্তাবও শিক্ষক সংগঠনগুলোর দিক থেকে সরকারের কাছে দেয়া দরকার। অভিজ্ঞতা থেকেই আমার এই সবিনয় নিবেদন।

অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর অন্যতম প্রণেতা
principalqfahmed@yahoo.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ