ইদানিং কাজে যেতে খোকা আমার কাছ থেকে
কেমনভাবে যেনো বিদায় নেয় ।
মনে হয় ফুলের পাপড়ির এক একটা ছিঁড়ে নিয়ে যায় ,
মনে হয় অমোঘ অভিমানে মুখে মেঘ মাখে ,
মনে হয় খোকা আমার আঁচল কোমরে বেঁধে নিতে চায় ,
এটাও মনে হয় - আঁচলের সাথে আমি যেনো না যাই ।
মনে হয় খোকা দূরের কোন অজানায় যাচ্ছে ।
ইদানিং খোকা নিজে নিজে নিজের দুই পা হাতড়ায় ,
বিড়বিড় করে কি সব দুর্বোধ্য শব্দ আওড়ায় ,
নিজের শরীর যতটুকু পারে - স্পর্শ করে পরম মমতায় ।
আমি খোকাকে দেখি , খোকা যেনো মৃত চোখে থাকে ।
একবার , দুইবার ডাকেও কখনো সাড়া দেয় না ।
মনে হয় খোকা ভাবনার অতলান্তিকে ডুবে যাচ্ছে ।
ইদানিং কাজে যেতে খোকা আমার কাছ থেকে
কেমনভাবে যেনো বিদায় নেয় ।
যেতে যেতে চোখে জল - আর ঘরে ফিরেই কি উচ্ছ্বাস !!!
মনে হয় খোকার যেনো ফেরার কথাই ছিলো না ।
আমার বুকে মাথা গুঁজে চোখের আনন্দের জল লুকোয় ।
খোকা ভাবে - আঁচলে জল মুছে যায় ,
মায়ের অসীম প্রান্তরের বুক ভেজে না ।
মনে হয় কখনো কখনো খোকা আমার অচেনাই ।
ইদানিং খোকা বারবার আমার ইচ্ছের কথা জানতে চায় ।
আমি কি খেতে চাই , কোন রঙের শাড়ি পড়তে চাই ,
ঘরের কোন আসবাবের অভাববোধ আমার , আরো অনেক ।
আলমারির চাবির গোছা আমার হাতে দিয়ে দিব্যি দিয়ে বলে -
যে করেই হোক , আমি যেনো আমার ইচ্ছেগুলো , শখগুলো ,
স্বপ্নগুলো মনের তুলিতে সাজাতে যাই লাগুক না কেনো -
তার বহু কষ্টের জমানো টাকা থেকেই খরচ করি ।
আমি এইবার মুখ ফুটেই বলে ফেলি - খোকারে !!!
আমার অপূর্ণতা কোথায় ? তুই মানিক থাকতে আর কি ?
খোকা এইবার কেঁদেই ফেলে , আমি হাহাকার করে উঠি ;
খোকা বলে - আমি যদি কখনো আর ফিরে না আসি মা ?
আমি যদি নপুংশকদের অনল খেলায় ঝলসে যাই ?
হাসপাতালের মর্গে পড়ে থাকা আমার লাশ যদি না চেনো ?
কতো খোকাই আমার মতো মায়ের মুখ দেখে , হাসিমুখে
চিরচেনা পথে বেরোয় , মৌলিক চাহিদার পূরণে , আমিও তো !!
মা এইবার আর কথা বলে না । খোকার দিকেও তাকায় না ।
খোকাও প্রতিদিনের মতো চোখের জলে আঁচল ভাসিয়ে
কাজে যায় , অন্ন যোগাড় করতে - ভীতসন্ত্রস্ত বুকে ।
মনে করে মা - তিন মাস ক্ষণে ক্ষণে ধর্ষিতা '৭১ - এ ,
মুক্তিযুদ্ধে স্বামীহীনা , রাজাকার দেবরের ভাঙ্গা ডেরা দখল ,
মনে করে - ২৯৩ কিলোমিটার হেঁটে এই ইট পাথরের
মায়াহীন শহরের বুকে পদার্পণ ; স্বাধীনতার পরের দিনেই
আবার ধর্ষণ , ধর্ষণের পর ধর্ষণ - রাতভর -
আশ্রয় দেওয়ার ছলে খোকার বাবার ছোটবেলার বন্ধু ;
কতোটুকুনই বা ছিলো খোকা ? বছর তিনেক ?
আজো মায়ের বুক খালি হয় । আজো নাকি মানুষ
পুড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে করিমের ১১ সন্তানের মতো ।
খোকা জানে না তার মায়ের ভেতরের পোড়া রাজ্যের কথা ।
ঘ্রাণও না , কষ্টও না , হাহাকারও না , কিচ্ছু না ।
আমি এতোটা বছর নীরব থেকেছি -
এইবারের আগুনে যদি আমার সন্তান পুড়ে -
আমি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল পুড়িয়ে দেবো
কিংবা রক্তপানের নেশা মনের বনে চড়াবো ।


0 মন্তব্যসমূহ