Header Ads Widget


রহস্যময়ী করোনায় করণীয়


আমরা এখন কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরের দিকে যাচ্ছি। এর অর্থ্যাৎ কমিউনিটি পর্যায়ে করোনার বিস্তৃতি ঘটছে। এ পর্যায়ে রোগ বিস্তৃতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। যেহেতু এখন পর্যন্ত কার্যকর ঔষধ কিংবা টিকা আবিষ্কার হয়নি, তাই করোনা প্রতিরোধেই আমাদের সর্বোতভাবে নিয়োজিত হতে হবে।
এ পর্যন্ত ৭ (সাত) প্রকারের করোনা ভাইরাস প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহে সংক্রমিত হয়েছে। সাধারণ সর্দি-কাশির (common cold), ১৫ পর্যন্ত করোনা ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট। ইতিপূর্বে ২ (দুই)টি মহামারী দেখা দিয়েছিল- ২০০৩ সালে ও ২০১২ সালে। অভিনব ২টি করোনা ভাইরাস SARS-COV-1 ও MERS-COV যথাক্রমে এর জন্য দায়ী।
এখন যে ভয়াবহ করোনা মহামারী চলছে তা প্রথমে শুরু হয় চীনের হুবেইপ্রদেশের উহান থেকে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯। এ অভিনব ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় SARS-COV-2। তিন মাসের মধ্যে করোনা মহামারী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বিশ্বের ২০৯টি দেশ ও ২ (দুই)টি আন্তর্জাতিক অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। জ্যামিতিক হারে আক্রান্তের হার, তার সঙ্গে মৃত্যুহারও বেড়ে চলেছে।
আমাদের দেশেও যাতে ঘাতক করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেজন্য সরকার জনসচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে বিভিন্নভাবে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে ও মহামারী নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
কোভিড-৯ রোগের লক্ষণ যেমন- জ্বর, সরদি, কাশি, গলাব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে; কারণ করোনা অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাস। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অসংখ্য ভাইরাস ড্রপলেট আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, যার সংস্পর্শে সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারে। যারা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন তাদেরও কমপক্ষে ১৪ (চৌদ্দ) দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। এ পর্যন্ত ২১৮ জন (সম্ভবত আরও অনেক বেশি) আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে ২০ জন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুবরণ করেছেন।
বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারীতে শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবাই কমবেশি জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। তাই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সামাজিক শিষ্টাচারসহ হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলার বিকল্প নেই। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে নিম্নবর্ণিত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললে শুধু করোনাই নয়, অন্যান্য অনেক সংক্রামক রোগ থেকেও নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারি।
১। কঠোরভাবে লকডাউন ও সংঘ নিরোধ মেনে চলুন।
২। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি সৃষ্ট ড্রপলেটের মাধ্যমে যেহেতু রোগটি ছড়ায়, তাই কাশির শিষ্টাচার বজায় রেখে যেখানে সেখানে কফ, থুতু না ফেলা, নাক ও মুখে মাস্ক, টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার ও হাতের তালুর পরিবর্তে কনুইয়ের ভাঁজ ব্যবহারও নিরাপদ। কখনো নিঃস্বব্দে কোনো লক্ষণ ছাড়াই করোনা ছড়িয়ে দিতে পারে (Asmptomatic carrier, 26%)। আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্তত ৬ (ছয়) ফুট দূরত্ব রেখে চলতে হবে। ১ জন আক্রান্ত ব্যক্তি গড়ে ২.৫ জনকে (১-৪) করোনা ছড়াতে পারেন।
৩। জুতা ঘরের বাইরে রাখাই বাঞ্ছনীয়। মাস্ক, গ্ল্যাভস আবার ব্যবহার না করে ঢাকনাযুক্ত বিনে ফেলুন।
৪। সিঁড়ির রেলিং ধরা নিষেধ। দরজার হাতল বা কলিং বেল স্পর্শ না করে বাইরে থেকে ডেকে দরজা খুলতে বলা বা সঙ্গে রাখা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে বেল বাজাতে পারেন।
৫। ঘরে ঢুকেই পরিহিত কাপড় ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পোশাক আলাদাভাবে ধৌত করতে হবে এবং হাত সাবান-পানি দিয়ে প্রতিবার কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে বারংবার ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে গোসল সেরে নেওয়া উত্তম।
৬। কখনই অপরিচ্ছন্ন হাতে নাক, মুখ ও চোখ স্পর্শ করা যাবে না।
৭। খাওয়ার আগে ও পরে সাবান-পানি এমনকি ছাই দিয়েও হাত পরিষ্কার করে নিতে পারেন।
৮। পরিবারের শিশু, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের প্রতি অধিক যত্নবান হোন। শিশুরা যেহেতু হ্যান্ড হাইজিন ও কফ এটিকেটের (শিষ্টাচার) বিষয়টি সঠিকভাবে পালন করতে পারে না, তাই তারা সহজেই অন্যদের রোগ সংক্রমণ করতে পারে। এমনকি শিশুদের মলের মাধ্যমেও রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা আছে। তাই শিশুর যত্নে মায়েদের আরও বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
৯। ৫০ বছর বয়সের নিচে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকে। ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন- লেবুর রস ও টাটকা শাক-সবজি, ফলমূল সাধারণভাবে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
১০। শিশুদের খাদ্যতালিকায় প্রোটিন, পর্যাপ্ত পরিমাণে শাক-সবজি ও তরল খাবার আবশ্যক। শিশু পর্যাপ্ত ঘুমালে শরীরে গ্রোথ হরমোন তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে এবং রোগ-বালাই দূরে থাকবে।
১১। এ সময় শিশু ও বয়স্কদের ঘরেব ভেতরে শারীরিক ব্যয়াম রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে দেয় ও মন প্রফুল্ল থাকে।
১২। বার বার গরম পানি পানে গলা ভেজা রাখে ও শ্বাসনালির ঝাড়ুপ্রক্রিয়া উদ্দীপ্ত হয়ে শ্লেষ্মা ও জীবাণু তুলে নিয়ে আসে, যা আমরা কাশির মাধ্যমে বের করে দিই, কিংবা গলাধঃকরণ করে ফেলি, এতে রোগীর অস্বস্তি অনেকাংশে দূরীভূত হয়।
১৩। সর্দি, কাশি, জ্বর, গলাব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতালে ছোটাছুটি না করে ঘরে থেকেই স্বাস্থ্য বাতায়নের মাধ্যমে ১৬২৬৩ চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন ও এই সময় নিজে পরিবারের অন্যান্য সদস্য থেকে আলাদা থাকুন। শতকরা ৮০ ভাগ রোগী সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ওঠে; কিন্তু সুস্থ না হয়ে ২য় সপ্তাহে তীব্র জর ও শ্বাসকষ্ট ও দুর্বলতা বেড়ে গেলে আইইডিসিআরের পরামর্শ নিন। আইসিউতে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।
১৪। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে করোনা ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির কথাবার্তা; এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে উত্থিত বায়োএরোসলের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। তাই রোগীর কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সেক্ষেত্রে সেবাদানকারীর যথাযথ পিপিই ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়।
১৫। কার্যকর চিকিৎসা না থাকাতে, পুরনো চিকিংসা পদ্ধতি রক্ত-রস থ্রাপিতে ৩৬-৭৩ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই ১২ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ম্যালেরিয়ার ওষুধ Hydroxichloroquin মাঝারী থেকে তীব্র করোনায় আক্রান্ত রোগীর তীব্রতা কমিয়ে দেয়, যদিও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বিভিন্ন দেশে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়েছে, যদিও WHO এখনো অনুমোদন দেয়নি, ভারত সরকার এ ওষুধটি করোনা prophylactic হিসেবে চিকিৎসাসেবা দানকারীদের সেবনের অনুমতি দিয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে রহস্যময় এ ভাইরাসটি স্পাইক প্রোটিনের দ্বারা মানবদেহের শ্বাসনালির কোষে আক্রমণ করে। তাই এ প্রোটিনের প্রকৃতি বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান টিকা আবিষ্কারের পথে অনেকদূর এগিয়েছে; এমনকি মানবদেহে সফল পরীক্ষামূলক প্রয়োগও হয়েছে। আশা করা যায় নিকট ভবিষ্যতে আমরা এ ভাইরাস প্রতিরোধী কার্যকর টিকার সুফল পাব এবং পৃথিবী করোনার করাল গ্রাস থেকে মুক্ত হবে।
লেখক :ডা. সুদেশ রক্ষিত, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
শিশু বিভাগ, যশোর মেডিক্যাল কলেজ, যশোর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ